মোঃ আনোয়ার হোসেন
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, প্রবাদ আছে চোরে শুনে না ধর্মের কাহিনী, গাজীপুরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) দুর্নীতির আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ বাণিজ্য চলে এ যেন দেখার কেউ নেই। আর এসব নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সহকারী মোটরযান পরিদর্শক সারোয়ার ও পিয়ন জামান। প্রতি পেশাদার লাইসেন্স বাবদ ১০ হাজার ও অপেশাদার লাইসেন্স বাবদ ১২ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়া হয়। প্রতিটা সেক্টরে ধাপে ধাপ এভাবে টাকা নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালায়। ঘুষ ছাড়া কোন সেবাই পাওয়া যায় না।
দালালের মাধ্যমেই উপার্জিত ঘুষের টাকা বিভিন্ন লেভেলের কর্মকর্তাসহ হলুদ সাংবাদিকদের কাছে চলে যায়। ঘুষ খেয়ে মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এ যেন এক গণেশের কেরামতি খেলা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কথা উঠলেই যানবাহন-সংশ্লিষ্ট সবার চোখের সামনে এক ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র ভেসে ওঠে। ভোগান্তির অপর নাম যেন বিআরটিএ। তবে দালালের শরণাপন্ন হলে সহজেই হয়ে যায় ভোগান্তির উপশম। আর এ জন্য গুনতে হয় মোটা অঙ্কের ঘুষ। বস্তুত বিআরটিএ কার্যালয়ের পরতে পরতেই ঘুষ। দালালচক্রের মাধ্যমে প্রতিটি কাজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রেটে ঘুস আদায় করা হয়। এছাড়াও নম্বর প্লেট, ফিটনেস, লার্নার, মালিকানা পরিবর্তন, রেজিস্ট্রেশন এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স সংক্রান্ত কাজে সেখানে ঘুষ বাণিজ্য ওপেন সিক্রেট।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে গিয়ে জানা যায়, ঘুষ দিয়েই পাশ করা যায় ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষায়; দক্ষতা প্রমাণের দরকার হয় না। ঘুষ দিয়েই ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়া যায় ফিটনেসবিহীন গাড়ির। সহকারী মোটরযান পরিদর্শক সারোয়ার তার দালাল সাত্তার, জিন্নাহকে সাথে নিয়ে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করছেন। দেখা মিলে গাজীপুর-থ ১১-৭৪৬৬ ও ১১-৩৭৭৯ নম্বরের সিএনজি চালিত ৩ চাকার, ঢাকা মেট্টো ন-২০-৩২২৩ নম্বরের পিকাপ গাড়ির চালক দালালের সাথে গোপনে লেনদেন করছে। সারোয়ারের পাশেই দাড়িয়ে আছে দালাল সদর থানার পশ্চিম জয়দেবপুর এলাকার আফজাল, ধীরাশ্রম এলাকার সোলেমান। বিআরটিএ কার্যালয়ের ২য় তলার ৪নং কক্ষে বসে আছে পিয়ন জামান। সেই কক্ষে রয়েছে তার আপন ছোট ভাই- এরশাদ, শ্যালক- মারুফ, ভায়রা ভাই- মনির, চাচা-বাবলু, ভাতিজা কাদের। উনারা সকলেই জামানের নেতৃত্বে দালালি করে। তাদের বাড়ী শ্রীপুর থানার রাজাবাড়ী এলাকায়। ঘুষ বাণিজ্য ছাড়া কাজ করা হয় না আর এসব ঘুষ বাণিজ্যের ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে আসা হয়রানির শিকার হয়েছেন এমনই এক ভুক্তভোগী মোঃ রাজিব জানান তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে দালালকে ১১ হাজার টাকা দিয়েছেন কিন্তু তার কাজ সম্পন্ন হয়নি। আজকাল বলে ছয় মাস ধরে তাকে ঘুরাচ্ছে এই ভুক্তভোগী রাজিবের বাড়ি কাপাসিয়া। তিনি এখনও ড্রাইভিং লাইসেন্স পায় নি। বিআরটিএ ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র ভেসে উঠে ভোগান্তির অপর নাম যেন বিআরটিএ।
আরো জানা যায়, টাঙ্গাইল বিআরটিএ অফিস থেকে বদলি হয়ে গাজীপুরে আসার পর থেকেই তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। বিআরটিএর আলোচিত কর্মকর্তা মাসুদের আত্মীয় হওয়ায় তিনি যেখানে যান, সেখানেই ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দুর্নীতি চালিয়ে যান। এছাড়া অভিযোগ রয়েছে জামান জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করে বয়স পরিবর্তন ও সার্টিফিকেট সৃজন করে চাকুরীতে যোগদান করেছে।
মালিকানা পরিবর্তন করার বিষয়ে রাজ্জাক নামের এক দালালের কাছে জানতে চাইলে সে বলেন, সারোয়ার স্যারকে ৩ হাজার ৫ শত টাকা করে দেওয়া লাগে।
বস্তুত এ চিত্র কেবল গাজীপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের নয়, দেশের প্রায় সব বিআরটিএ কার্যালয়েই কম-বেশি এ অবস্থা বিরাজ করছে। দালালদের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হয়। কিছুদিন পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত ভালো থাকে; তারপর আবার সবকিছু আগের মতো।
এর কারণ দালালদের তৎপরতা চলে বিআরটিএ’র এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে। মূলত তারাই দালালদের পৃষ্ঠপোষক। তাই বন্ধ হয় না বিআরটিএ কার্যালয়ের দুর্নীতি এবং দালালদের অপতৎপরতায় প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ বাণিজ্য চলে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সড়কের নিরাপত্তার বিষয়টি। অদক্ষ চালক লাইসেন্স পেয়ে গাড়ি চালালে অথবা সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চললে এর পরিণতি কী হতে পারে, তা সবার জানা। বস্তুত এসব কারণেই দেশে সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
তাই সরকারের উচিত এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এবং বিআরটিএ কার্যালয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা করা। তবে সেক্ষেত্রে দেখতে হবে শর্ষের ভেতরেই যেন ভূত না থাকে। অর্থাৎ নজরদারির দায়িত্ব যাদের দেওয়া হবে, তারাও যেন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে না পড়ে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পারলে নিম্নপর্যায়ের দুর্নীতিও রোধ করা সম্ভব। মুশকিল হচ্ছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘুষের লোভ সংবরণ করতে পারেন না। তাই আশকারা পায় অধিস্তনরা, গজিয়ে ওঠে দালালচক্র। সড়ক পরিবহণ মন্ত্রণালয় তথা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় যদি বিআরটিএ’র দুর্নীতি রোধে আন্তরিক হয়, একমাত্র তাতেই মিলতে পারে সুফল।
এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে গাজীপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে একাধিকবার ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ ও এসএমএসের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
সম্পাদক ও প্রকাশক : হাসান জাকির
নির্বাহী সম্পাদক : মোঃ আনোয়ার হোসেন
০১৭১৫০৩১৬৫৫
অফিস- চান্দনা চৌরাস্তা, আমান্তা টাওয়ার, বাসন থানা, গাজীপুর।